‘জনতার বিচার’ ও বিচারপতির জেলে যাওয়া প্রসঙ্গে
‘জনতার বিচার’ দেখে জেলে গেলেন। এটি একটি সংবাদপ্রতিবেদনের শিরোনাম। জনতাকর্তৃক আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে সোপর্দ করা ও পরবর্তীতে আদালতে নেওয়ার প্রাক্কালে জনতা কর্তৃক গণধোলাইয়ের শিকারে পরিণত হওয়া একজন প্রাক্তন বিচারপতি সম্পর্কে এমন অদ্ভুত শিরোনাম করা হয়েছে। এখানে এই বিচারপতির অন্যায় ও পক্ষাপাতদুষ্ট বিচারে প্রক্ষুব্ধ জনতা কর্তৃক গণধোলাইয়ের মুখে পড়ে নাজেহাল হওয়া অর্থাৎ ‘জনতার বিচার’ কার্যকর হওয়ার প্রসঙ্গটি প্রকটিত হয়েছে।
প্রতিবেদনে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা হয়েছে, “গত শুক্রবার (২৩ আগস্ট) রাত ১১টা ২০ মিনিটে সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার দনা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালানোর সময় আলোচিত সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে আটক করে বিজিবির কাছে হস্তান্তরিত করেন স্থানীয় মানুষজন। পরে ভোরে বিজিবি তাকে কানাইঘাট পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে।”
কথা হলো, একজন বিচারপতি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে দেশ ছেড়ে পালাবেন কেন? তিনি কী এমন অপকর্ম করেছেন যে, তাঁকে গোপনে দেশত্যাগ করতে হবে? এর পেছনে তো নিশ্চয়ই একটা কীছু কারণ অবশ্যই থাকতে হবে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নতুন পরিসরে যা অপরাধ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। একজন বিচারপতির কাজ আদালতে উপস্থাপিত আলামত, সাক্ষ্যসাবুদ ও আইনি যুক্তির বিবেচনা করে নিরপেক্ষ থেকে রায় প্রদান করা, অর্থাৎ রাষ্ট্রের সরকার কর্তৃক অনুমোদিত সকলের জন্য অবশ্যপালনীয় মূর্তনির্দিষ্ট আচরণবিধির কার্যকারিতা নিশ্চিত করা। কিন্তু মনে হচ্ছে, উক্ত বিচারপতি সেইসব নির্ধারিত আচরণবিধির ঊর্ধ্বে উঠে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের পক্ষাবলম্বন করে সরকারের বিরোধীপক্ষের প্রতি বিচারের নামে অবিচার করেছেন, যা একজন বিচারপতির পক্ষে কোনও যুক্তি-বিচারেই সঙ্গত নয়। বিচারকাজ করার সময় বিচারপতি নিরপেক্ষ ছিলেন না, তিনি বিশেষ ক্ষমতাসীন দলের অনুকূলে বিচারকাজ করেছেন, সেটা স্পষ্ট একটা অবিচার। সাধারণ মানুষ সে-অবিচারে ক্ষুব্ধ হয়েছেন চেতনাগতভাবে, বাস্তব দৃষ্টান্ত হয়ে তারই বহিঃপ্রকাশ এই গণধোলাইরূপ ‘জনতার বিচার’।
ঘটনাটি যতোই অদ্ভুত ঠেকুক না কেন তার মধ্যে একটি ঐতিহাসিক সত্য নিহিত আছে। সেটি হলো : কোনও আর্থসামাজিক ব্যবস্থার গঠন এমন একটি রূপপর্যায়ে পৌঁছে যেতে পারে যখন সমাজের সিংহভাগ মানুষকে নির্মম শোষণ-নির্যাতনের চাকার তলে পিষ্ট করে বান্ধবপোষণ অর্থনীতি (ক্রোনি ক্যাপিটালিজম) প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সমাজ ঘুষ, দুর্নীতি, আত্মসাৎ ও খুনের অবাধ ক্ষেত্রে পরিণত হয়, যে-পরিসরে বিচার ব্যবস্থায় বিচারের নামে অবিচার চলতে থাকে, বিচারপতি তাঁর স্বাভাবিক বিবেককে বিক্রি করে দেন ব্যক্তিগত সম্পদ আহরণের মোহে অন্ধ হয়ে গিয়ে, অর্থাৎ বান্ধবপোষণ অর্থনীতির (ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের) পরিসরে সীমাহীনভাবে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাড়ানোর লোভে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েন ব্যতিক্রম বাদে অনেকে।
এই ধরণের নীতিভ্রষ্ট বিচারপতিকে সাধারণ মানুষ ঘৃণা করেন, তারই প্রতিফলন ঘটেছে “-‘জনতার বিচার’ দেখে জেলে গেলেন” শিরোনামের বাক্যবিস্তারে। দেশের বৈচারিক পরিসরে প্রতিষ্ঠিত এই অপরিণামদর্শিতা সাধারণ দেশবাসীর কাছে একটি পরিতাপের বিষয় বটে। এর অবসান চাই। আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে এই দাবি করছি যে, দেশের বিচারব্যবস্থার এই অবনতিশীল পরিস্থিতির অবসানকল্পে বিধিসম্মত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ